বাংলা ব্যাকরণকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে- বাংলা ভাষার পরিমণ্ডলে চিন্তা করা উচিৎ। এক্ষেত্রে অন্যান্য ব্যাকরণের বক্তব্যগুলো বাংলা ব্যাকরণে সুচিন্তিতভাব প্রয়োগ বা বর্জন করা যেতে পারে।
বাংলা বাক্যের অন্তর্গত শব্দাবলির অর্থগত-বৈশিষ্ট্যে বিচার করতে গেলে দেখা যায়, শব্দের গঠন সব সময় একই রকম নেই। যেমন- 'পাখি' শব্দটিকে যদি ধরে নেই বিশেষ্য। তা হলে- দেখা যাবে অন্যান্য জায়গায় তা হয়ে গেছে- পাখিটি, পাখিটা, পাখিকে, পাখির ইত্যাদি। এই বিচারে বাক্যে ব্যবহৃত বিশেষ্যকে ৪টি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।
১. মূল বিশেষ্য : যে সকল বিশেষ্যের সাথে অন্যকোন ধ্বনি বা শব্দ যুক্ত হয় নাই। যেমন- ফুল পাখি, নদী ইত্যাদি।
২. সম্প্রসারিত বিশেষ্য : মূল বিশেষ্য পদের সাথে অব্যয় বা বিভক্তি যুক্ত হয়ে তার ভাবকে সম্প্রসারিত করে। যেমন- ফুলটি, পাখিটি, নদীর ইত্যাদি।
৩. মিশ্র বিশেষ্য : দুটি ভিন্ন ভিন্ন শব্দ একত্রিত হয়ে একটি পদ তৈরি করে, যা বিশেষ্য হিসাবে ব্যাক্যে ব্যবহৃত হয়। যেমন-
বিশেষ্য + বিশেষ্য [সিংহ +আসন=সিংহাসন]
বিশেষ্য +বিশেষণ [তুষার +শুভ্র =তুষারশুভ্র]
বিশেষণ + বিশেষ্য [কৃষ্ণ +কলি=কৃষ্ণকলি]
বিশেষণ +বিশেষণ [চালাক +চতুর=চালাক-চতুর]
৪. দ্বিরুক্ত বিশেষ্য : বাক্যে ব্যবহৃত মূল বিশেষ্যপদের বহুবচনীয় অর্থ প্রকাশের জন্য অন্য একটি সহচর শব্দ ব্যবহার করে নানাবিধ, সমূহ ইত্যাদি অর্থ প্রকাশ করে এবং উভয় শব্দ মিলে একটি বিশেষ্য পদ তৈরি করে। যা মূল শব্দের বহুত্বকে বুঝায় না, বরং মূলসত্তা-সহ অন্যান্য উপকরণ-সহ বুঝায়। যেমন-
জিনিস [বিশেষ্য] +পত্র [অন্যান্য]=জিনিষপত্র [বিশেষ]
৫. অনুসর্গীয় ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য
বাক্যে ব্যবহৃত মূল বিশেষ্যপদের সাথে, কোনো ক্রিয়াপদ অনুসর্গের মতো যুক্ত হয়ে কখনো কখনো সংযোজক বিশেষ্য পদের সৃষ্টি করে। এই জাতীয় শব্দে ক্রিয়ার ভাব বজায় থাকে, কিন্তু ক্রিয়াপদের মতো, কাল ও পুরুষ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন রূপ লাভ করে না। যেমন-
সাঁতার কাটা, মাছ ধরা, পত্র করা ইত্যাদি।
গঠন বা উৎপত্তির বিচারে বিশেষ্য পদের বিশ্লেষণ
শুরুতেই উল্লেখ করেছি যে, একই শব্দ বাক্যে ব্যবহারের প্রকৃতির অনুসারে বিশেষ্য বা বিশেষণ হতে পারে। এ প্রসঙ্গে উদাহারণ হিসাবে নীল শব্দটির উল্লেখ করেছি। বিশেষ্য ও বিশেষণ নির্ণয়ে এই জাতীয় বিষয় থাকা সত্ত্বে কিছ কিছু শব্দকে প্রাথমিক নির্বাচনে বিশেষ্য বা বিশেষণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। এই শব্দগুলোতই কার্যকরণে পদ-নাম পাল্টায়। প্রাথমিক বিচারে আমরা যে সকল শব্দকে বিশেষ্য হিসাবেই বিচার করে থাকি, তার বিচারে বিশেষ্য গঠনের নিয়ামাবলি নিচে তুলে ধরা হলো।
ক। সহজাত বিশেষ্য : শব্দগঠনের বিচার ছাড়াই কোনো কোনো শব্দ সহজাত ধর্মে বিশেষ্য হয়ে থাকে। যেমন- পৃথিবী। এই শব্দের গঠন পদ্ধতি যাই হোক না কেন, একটি গ্রহের নাম অনুসারে বিশেষ্য হবে। আবার ব্যক্তি বা স্থানের নামের অর্থ থাক বা না থাক, এগুলো বিশেষ্যই হবে। আমার পরিচিতা একটি মেয়ের নাম ‘কিন্তু’। পদের বিচারে ‘কিন্তু’ অব্যয়। কিন্তু মেয়ের নাম হিসাবে ‘কিন্তু’ বিশেষ্য।
খ। প্রত্যয়যোগ শব্দের বিশেষ্য নির্ণয়
কিছু কিছু শব্দের ক্ষেত্রে দেখা যায় ধাতুমূল বা শব্দমূলের সাথে প্রত্যয় যুক্ত হওয়ার পর, তা বিশেষ্যে পরিণত হয়। কিম্বা কোনো কোনো শব্দকে বিশেষ্য পরিণত করার জন্য সুনির্দিষ্ট প্রত্যয় ব্যবহার করা হয়। যেমন- তা, ত্ব ইত্যাদি প্রত্যয়। প্রত্যয়জাত এই সকল বিশেষ্যর নমুনা নিচে তুলে ধরা হলো।
১। তত্সম শব্দের ক্ষেত্রে ধাতুর পরে অনট, ঘঞ্, ত, অল্ (অচ্, অপ্), ক্তি (ক্তিন্) ইত্যাদি প্রত্যয় যুক্ত হয়ে বিশেষ্য গঠিত হয়। যেমন-
প্রত্যয় | গঠিত বিশেষ্য পদ |
অনট্ | আ-Öখ্যা (বর্ণনা করা) +অনট্ =আখ্যান |
ঘঞ্ | ভিদ্ Ö (ভেদ করা) + অ (ঘঞ্) =ভেদ। |
ত (ক্ত) | আ-Öগম (গমন করা) +ত (ক্ত)=আগত। |
তি (ক্তি) | Öভজ্ (সেবা করা +তি (ক্তিন) =ভক্তি। |
২। তত্সম শব্দের ক্ষেত্রে, শব্দের পরে ই (ইঞ্), ইমন, তর, তম, তা, ত্ব, র, ল, ষ্ণ (অপত্যার্থ, উপাসক), ষ্ণেয়, ষ্ণ্য ইত্যাদি প্রত্যয় যুক্ত হয়ে বিশেষ্য গঠিত হয়। যেমন-
প্রত্যয় | গঠিত বিশেষ্য পদ |
ই (ইঞ) | রাবণ +ই =রাবণি। |
ইমন | নীল +ইমন =নীলিমা। |
তর | মধুর +তর =মধুরতর |
তম | প্রিয় +তম =প্রিয়তম |
তা | মানব +তা =মানবতা। |
ত্ব | ক্লীব +ত্ব =ক্লীবত্ব। |
র | মধু +র =মধুর। |
ল | শীত +ল=শীতল। |
ষ্ণ | মনু +ষ্ণ (অপত্যার্থ্) =মানব। |
ষ্ণেয় | ভাগিনী +ষ্ণেয় =ভাগ্নেয় |
ষ্ণ্য | সুন্দর +ষ্ণ্য =সৌন্দর্য্য। |
৩। দেশি শব্দের ক্ষেত্রে, তদ্ধিত প্রত্যয় যোগে বাংলা শব্দের বিশেষ্য নির্ণয় : প্রত্যয়যোগে বিশেষ্য পদ তৈরি হয়। যেমন-
প্রত্যয় | গঠিত বিশেষ্য পদ |
আ | হাত +আ =হাতা |
আই | চড়্ +আই =চড়াই |
বিশেষ্যের লিঙ্গ-বিচার
বাংলাভাষায় বিশেষ্যের লিঙ্গ বিচার করে সুনির্দিষ্ট নিয়মের ভিতরে ফেলা যায় না। বাংলা ভাষায় সংস্কৃত ব্যাকরণের বিধি, অ-তৎসম শব্দের বিধি ও সাম্প্রতিক ধারণার ভিত্তিতে লিঙ্গবিচার করা হয়ে থাকে। যেমন-
উপাসনা স্ত্রীলিঙ্গ (সংস্কৃত ব্যাকরণ-বিধি অনুসারে)
কাকি স্ত্রীলিঙ্গ (অ-তৎসম শব্দের বিধি অনুসারে)
কম্পিউটার ক্লীবলিঙ্গ (অপর ধারণার সূত্রে)
এই বিচারে বিশেষ্যর লিঙ্গ বিচার করা যেতে পারে তিনটি রীতি অনুসারে। এই রীতি তিনটি হলো-
১। তৎসম বিধি: তৎসম শব্দগুলোর ক্ষেত্রে যে বিধি প্রচলিত আছে তা সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুসারে হবে। যেমন-
উপাসন ={উপ (নিকট) + Öআস্ (উপবেশন করা) +অনট্}। এই শব্দটি ক্লীবলিঙ্গ। কিন্তু এর সাথে আপ্ প্রত্যয় যোগে উপসনা হলে তা স্ত্রীলিঙ্গ হয়। অর্থাৎ উপাসন ={উপ (নিকট) + Öআস্ (উপবেশন করা) +অনট্}। ক্লীবলিঙ্গ।
উপাসনা =উপাসন + আ (আপ্)। স্ত্রীলিঙ্গ।
এইরূপ অন্যান্য শব্দ হতে পারে- কল্যাণী, নদী, পৃথিবী, সূর্য, ইত্যাদি।
২. প্রচলিত অ-তৎসম বিধি : অ-তৎসম শব্দের যে সকল শব্দের লিঙ্গ নির্ধারণ ও তার ব্যবহার দীর্ঘ-দিন ধরে প্রচলিত আছে, সেগুলো অনুসৃত হবে। যেমন-
পুরুষবাচক শব্দ : কাকা, চাচা, ভাই, মামা, বুড়া ইত্যাদি।
স্ত্রীবাচক অ-তৎসম শব্দ : কাকি, গিন্নি, চাচি, দিদি, নানি, পিসি, বৌদি, ভাবি, মামি, মাসি, বুড়ি ইত্যাদি।
৩. অপর বিধি : সংস্কৃত ব্যাকরণে এবং প্রচলিত তৎসম-বিধির বাইরে সকল শব্দকে অপর-বিধির ভিতরে ধরা হবে। এক্ষেত্রে লিঙ্গ বিচার করা হবে ৪টি সূত্রে। যেমন-
ক। প্রথম সূত্র : পুংলিঙ্গ, স্ত্রীলিঙ্গ ও উভয়লিঙ্গ বিচার করা হবে প্রাণীর জৈবিক বিচারে। যেমন- উভয়লিঙ্গ : অ্যামিবা, ডাইনোসর ইত্যাদি
খ। দ্বিতীয় সূত্র : অপ্রাণীবাচক, ধারণাবাচক শব্দ ক্লীবলিঙ্গ হবে। যেমন- কম্পিউটার, ঢাকা, সিনেমা ইত্যাদি।
খ। তৃতীয় সূত্র : প্রাণীবাচক শব্দ হওয়ার পরও যারা ক্লীবত্ব ধারণ করে, তাদের ক্লীবলিঙ্গ বলা হবে। যেমন- হিজরা। যেমন-
১. যদিও শব্দের প্রাথমিক সংজ্ঞায় বলা হয়- অর্থবোধক ধ্বনি হলো শব্দ। কিন্তু সব সময় এই সংজ্ঞা দিয়ে শব্দকে বিচার করাটা সমস্যা হয়ে যায়। যেমন- আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে। এখানে আগডুম, বাগডুম ও ঘোড়াডুম কি অর্থ বহন করে তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। ব্যাকরণে একে বলা হয়- অর্থহীন শব্দ (non-sense word)। এরকম হতে পারে 'হিংটিংছট্' যাদুশব্দ 'আলিমাৎ মাতাশা' ইত্যাদি। এশব্দগুলোর বিশেষ কোনো অর্থ না থাকলেও একটি নাম হিসাবে বিবেচনা করাই যেতে পারে। এই বিচারে শব্দ বা বিশেষ্যপদের সংজ্ঞার সাথে একটি শর্ত জুড়ে দিতে পারি। যেমন-
কোন কিছুর নামকেই বিশেষ্য বলে। এই নাম অর্থহীন বা অর্থযুক্ত নাম হতে পারে।
অর্থহীন নামের রাজ্যটি বেশি বড় নয়। তাই শ্রেণিবিভাজন নিয়ে খুব বেশি মাথা না ঘামাতে হয় না। নিতান্তই যদি এর শ্রেণিবিভাজন করতে হয়, তাহলে তা হতে পারে-
আগডুম {বিশেষ্য। অর্থহীন নাম, ছড়া}
মাতাশা {বিশেষ্য। অর্থহীন নাম, যাদুমন্ত্র}
সুতরাং প্রাথমিকভাবে বিশেষ্যকে আমরা দুটি ভাগে ভাগ করতে পারি।
১.১. বিশেষ্য অর্থহীন । যে শব্দ থেকে সমার্থক কোনো শব্দ বা শব্দসমষ্টি পাওয়া যায় না।
১.২. বিশেষ্য অর্থযুক্ত ।
১.২. যে শব্দ থেকে সমার্থক কোন না কোনো সমার্থক শব্দ বা শব্দগুচ্ছ পাওয়া যায়।
বিশেষ্য অর্থযুক্ত অর্থের বিচারে কোনো শব্দকে বিবেচনা করে এবং তার একটি নাম আছে এই অর্থে বিশেষ্যকে শ্রেণিকরণ করতে গেলে বিভিন্ন ধরণের জিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। সাধারণভাবে একটি শব্দের এক বা একাধিক অর্থ থাকতে পারে। সে কারণে নাম হিসাবে শ্রেণিকরণের কাজটা একটু জটিল হয়ে পড়ে।