বাংলা লিপি হলো একটি লিখন পদ্ধতি যেটি বাংলা, মণিপুরি, ককবরক, অসমীয়া ভাষায় ব্যবহার করা হয়। পূর্ব নাগরী লিপি থেকে এই লিপির উদ্ভব। বাংলা লিপির গঠন তুলনামূলকভাবে কম আয়তাকার ও বেশি সর্পিল। বাংলা লিপিটি সিদ্ধং লিপি থেকে উদ্ভূত হয়েছে বলে মনে করা হয়। অনুরূপ হিসেবে অসমিয়াকে মনে করা হলেও অসমীয়া লিপির উৎপত্তি বাংলা লিপি উৎপত্তির অন্তত আড়াইশ বছর পর। যে ভিন্নতা (বাংলা র; অসমীয়া ৰ ও ৱ এবং স্বতন্ত্র বর্ণ হিসেবে ক্ষ) আধুনিক বাংলা ও অসমীয়া ভাষায় দেখা যায়, সেটি ১৮ শতকের আগে ছিল না। পরবর্তীতে নিচে ফোঁটা দেওয়া র বাংলায় ব্যবহৃত হয়। পূর্ব নাগরী লিপি বা বাংলা লিপি বিশ্বের ৫ম সর্বাধিক ব্যবহৃত লিখন পদ্ধতি।
ইতিহাস
উৎস
খ্রীঃ পূঃ দ্বিতীয়-প্রথম শতকে ব্রাহ্মী লিপির উত্তর ভারতীয় লিপিরূপ থেকে জন্ম নেয় কুষাণ লিপি, যা থেকে পরে গুপ্ত লিপির উৎপত্তি হয়। গুপ্ত লিপির ক্রমবিবর্তনের ফলে সিদ্ধমাতৃকা লিপির উৎপত্তি হয়, যার কালক্রমিক পরিণতি থেকে বাংলা লিপি বর্তমান রূপ ধারণ করে।
বাংলা লিপির ব্যবহার প্রায়ই মধ্যযুগীয় ভারতের পূর্বাঞ্চলে এবং তারপর পাল সাম্রাজ্যের মধ্যে ব্যবহার ছিল। পরে বিশেষভাবে বাংলার অঞ্চলে ব্যবহার করা অব্যাহত ছিল। পরে বাংলা লিপিটিকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্বের অধীনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর দ্বারা আধুনিক বাংলা লিপিতে প্রমিত করা হয়েছিল। বর্তমান দিনে বাংলা লিপিটি বাংলাদেশ ও ভারতে সরকারী লিপির পদমর্যাদা স্থানে আছে, এবং বাংলার মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে যুক্ত আছে।
বাংলা মুদ্রণের প্রথম অর্ধশতাব্দী
১৭৭৮ সালে ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেডের (হালেদ) আ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রকাশনার মাধ্যমে বাংলা মুদ্রণশিল্পের জন্ম হয়। বইটি ইংরেজি ভাষাতে লেখা হলেও এতে বাংলা বর্ণপরিচয় ও বাংলা লেখার নিদর্শন সবই বাংলা মুদ্রাক্ষরে ছাপা হয়। এই মুদ্রণে প্রথমবারের মত "বিচল হরফ" প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এই কৌশলে প্রতিটি হরফের জন্য আলাদা একটি ব্লক থাকে, যে ব্লকটিকে ইচ্ছামত নড়ানো ও বসানো যায়। জার্মানির ইয়োহানেস গুটেনবের্গ ছিলেন এই প্রযুক্তির উদ্ভাবক। বাংলা মুদ্রণে হালেদের বইতে চার্লস উইলকিন্স এবং তার সহকারী পঞ্চানন কর্মকার এই প্রযুক্তি প্রথমবারের মত প্রয়োগ করেন। ধাতুর ব্লকে ঢালাই করা একই আকৃতি একই হরফের জন্য একাধিক পাতাতে ব্যবহার করা যায় বলে বাংলা ছাপা হরফে একটা স্থায়ী, বৈষম্যহীন রূপ এসেছিল। তবে এই প্রথম দিককার হরফগুলি খুব সুদৃশ্য ও পরিণত ছিল না। ইংরেজির তুলনায় বাংলা হরফের আকার ছিল বেশ বড়। ইউরোপে এর প্রায় তিনশত বছর আগেই বিচল হরফে ছাপার প্রযুক্তি শুরু হয়ে গেলেও বাংলাতে এটি ছিল একেবারেই নতুন একটি ঘটনা। চার্লস উইলকিন্স ও তার সহকারী পঞ্চানন কর্মকার সম্ভবত এই বিষয়ে অভিজ্ঞ কারিগর ছিলেন না।
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রচয়িতা ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড কর্তৃক ১৭৭৮ সালে প্রকাশিত আ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ পুস্তকের স্ক্যান করা প্রচ্ছদ
১৮০০ সালে শ্রীরামপুরে ব্যাপটিস্ট মিশন প্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে উইলিয়াম কেরি ও উইলিয়াম ওয়ার্ড ছিলেন ছাপখান বিশেষজ্ঞ। তারা সেখানে পঞ্চানন কর্মকারের চাকরির ব্যবস্থা করেন। এদের মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলা হরফের চেহারার উন্নতি হতে থাকে। ১৯শ শতকের তৃতীয় দশকেই বাংলা ছাপার চেহারা অনেকখানি পাল্টে যায়। ১৮৩১ সালে ভিনসেন্ট ফিগিন্স সম্ভবত প্রথম বাণিজ্যিকভাবে বিক্রির জন্য বাংলা হরফ তৈরি করেছিলেন।
এসময়কার বাংলা হরফের বৈশিষ্ট্যগুলি এরকম:
- অনুস্বারের নিচের দাগটি ছিল না। ছিল কেবল গোল চিহ্নটি।
- ব্যঞ্জনের খাড়া দাগের সাথে য-ফলা মিলে বাঁকিয়ে কমলার কোয়ার মত একটা চেহারা ছিল। এগুলি আজও কখনো কখনো দেখতে পাওয়া যায়। আধুনিক কম্পিউটারের লিখন হরফে স্য-তে এর দেখা মেলে।
- "তু" যুক্তাক্ষরটি বর্তমান চেহারা পায়। অর্থাৎ "ত"-এর নিচে "ু" বসিয়ে।
- "স্থ" (স+থ) যুক্তাক্ষরটি হালেদের সময়ে, অর্থাৎ ১৮শ শতকে "স"-এর নিচে পরিষ্কার "থ" লিখে দেখানো হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তীতে এটি "স"-এর নিচে ছোট "হ"-এর মত অক্ষর বসিয়ে নির্দেশ করা হয়। ফলে যুক্তাক্ষরটি অস্বচ্ছ রূপ ধারণ করে। এখনো এই অস্বচ্ছ রূপটিই ব্যবহার করা হয়। এরকম আরো বহু যুক্তাক্ষরের অস্বচ্ছ রূপ ১৯শ শতকের শুরুর এই পর্বে নির্দিষ্ট হয়ে যায়।
- "র" অক্ষরটির হরফটি হালেদের সময়ে পেট কাটা "ব" (অসমীয়া ৰ) এবং "ব"-এর নিচে ফুটকি উভয় রূপেই বিদ্যমান ছিল। কিন্তু ১৮শ শতকের মাঝামাঝিতে এই পর্বের শেষে এসে বর্তমান ফুটকিযুক্ত রূপটিই সর্বত্র চালু হয়ে যায়।
বিদ্যাসাগরীয় সংস্কার
লাইনোটাইপ পর্ব
বাংলা অক্ষর
স্বরবর্ণ
স্বতন্ত্র আকার | স্বতন্ত্র আকারের নাম | বৈশিষ্ট্যসূচক চিহ্ন | বৈশিষ্ট্যসূচক চিহ্নের নাম | রোমানীকরণ | আ-ধ্ব-ব প্রতিলিপি |
---|---|---|---|---|---|
অ | স্বর অ | - | - | a,ô ও o(বিকৃত উচ্চারণ) | /ɔ/ ও /o/(বিকৃত উচ্চারণ) |
আ | স্বর আ | া | আ কার | aa/ ā | /ā/ |
ই | হ্রস্ব ই | ি | হ্রস্ব ই কার | i | /i/ |
ঈ | দীর্ঘ ই | ী | দীর্ঘ ই কার | i ও ee | /i/ |
উ | হ্রস্ব উ | ু | হ্রস্ব উ কার | u | /u/ |
ঊ | দীর্ঘ উ | ূ | দীর্ঘ উ কার | u ও oo | /u/ |
ঋ | হ্রস্ব ঋ | ৃ | হ্রস্ব ঋ কার | ri | /ṛi/ |
ৠ | দীর্ঘ ঋ | ৄ | দীর্ঘ ঋ কার | rii | /ṛii/ |
ঌ | হ্রস্ব ঌ | ৢ | হ্রস্ব ঌ কার | li | /ḷi/ |
ৡ | দীর্ঘ ঌ | ৣ | দীর্ঘ ঌ কার | lii | /ḷii/ |
এ | স্বর এ | ে | এ কার | e ও ê | /e/ ও /æ/ |
ঐ | স্বর ঐ | ৈ | ঐ কার | ôi ও oi | /ɔi/ ও /oi/ |
ও | স্বর ও | ো | ও কার | u ও o | /ʊ/ ও /o/ |
ঔ | স্বর ঔ | ৌ | ঔ কার | ôu ও ou | /ɔu/ ও /ou/ |
ব্যঞ্জনবর্ণ
- বাংলায় কিছু ব্যঞ্জনবর্ণের মধ্যে পূর্বে উচ্চারণে পার্থক্য থাকলেও এখন আর নেই, যেমন "ন" (দন্ত্য ন) ও "ণ" (মূর্ধন্য ণ)।
- "শ" (তালব্য শ) আর "ষ" (মূর্ধন্য ষ)-কে আধুনিক বাংলায় একই রকম উচ্চারণ করা হয়। "স" (দন্ত্য স) -র উচ্চারণ শব্দের উপর নির্ভর করে।
- "য" (অন্তঃস্থ য) আর "জ" (বর্গীয় জ)-র উচ্চারণও একই, তবে ফারসি-আরবি শব্দে এই ধ্বনির যে দন্ত্য উচ্চারণটি আছে, সেটি বুঝাতেও "য" ব্যবহৃত হয়, যেমন "দোযখ", "যাকাত"। এই দন্ত্য উচ্চারণটি বিভিন্ন আঞ্চলিক উচ্চারণেও শোনা যায়।
- নাসিক্য বর্ণ "ঙ" (উঙ/উম/উঁঅ) ও "ঞ" (ইঞ/নীয়/ইঁঅ) এবং অর্ধস্বর বর্ণ "য়" (অন্তঃস্থ অ) শব্দের প্রথমে আসতে পারে না।
- চলিত উচ্চারণে "ড়" (ড-এ শূন্য ড়) আর "ঢ়" (ঢ-এ শূন্য ঢ়)-এর উচ্চারণ কিছুটা "র"-এর কাছাকাছি। দুটোই শব্দের প্রথমে আসে না কারণ বিদ্যাসাগর এদের প্রবর্তন করেন শব্দের (শুধু) মাঝে বা শেষে "ড" এবং "ঢ"-এর তাড়নযাত উচ্চারণ ইঙ্গিত করতে।
স্পর্শ | অনুনাসিক | অন্তঃস্থ | ঊষ্ম | |||||
---|---|---|---|---|---|---|---|---|
বর্গীয় বর্ণ | ||||||||
অঘোষ | ঘোষ | অঘোষ | ঘোষ | |||||
অল্পপ্রাণ | মহাপ্রাণ | অল্পপ্রাণ | মহাপ্রাণ | অল্পপ্রাণ | মহাপ্রাণ | |||
কন্ঠ্য | ক /kɔ/ | খ /kʰɔ/ | গ /gɔ/ | ঘ /ɡʱɔ/ | ঙ /ŋɔ/ | হ /ɦɔ~hɔ/ | ||
তালব্য | চ /tʃɔ~tsɔ~sɔ/ | ছ /tʃʰɔ~tsʰɔ~sɔ/ | জ /dʒɔ~dzɔ~zɔ/ | ঝ /dʒʱɔ~dzʱɔ/ | ঞ /nɔ~ẽɔ/ | য /dʒɔ~dzɔ~zɔ/ | শ /ʃɔ~ɕɔ/ | |
মূর্ধন্য | ট /t̠ɔ/ | ঠ /t̠ʰɔ/ | ড /d̠ɔ/ | ঢ /d̠ʱɔ/ | ণ /nɔ/ | র /rɔ/ | ষ /ɕɔ~ʃɔ/ | |
দন্ত্য | ত /t̪ɔ/ | থ /t̪ʰɔ/ | দ /d̪ɔ/ | ধ /d̪ʱɔ/ | ন /nɔ/ | ল /lɔ/ | স /sɔ~ɕɔ~ʃɔ/ | |
ওষ্ঠ্য | প /pɔ/ | ফ /pʰɔ~ɸɔ~/f// | ব /bɔ/ | ভ /bʱɔ/ | ম /mɔ/ | ব /bɔ/ |
সংস্কার- পরবর্তী অক্ষরসমুহ | ড় /ɽɔ/ | ঢ় /ɽʱɔ/ | য় /e̯ɔ/ |
---|
সংশোধক বর্ণ
চিহ্ন | চিহ্নের নাম | কাজ |
---|---|---|
ৎ | খণ্ড ত | "ত" এর খণ্ড রূপ |
ং | অনুঃস্বর | "ঙ" এর খণ্ড রূপ |
ঃ | বিসর্গ | "হ্" এর আরেকটি রূপ, র এবং স বিলুপ্ত হয়ে বানানে বিসর্গ আসতে পারে, যেমন পুনর>পুনঃ, নমস> নমঃ |
ঁ | চন্দ্রবিন্দু | অনুনাসিক স্বর |
্ | হসন্ত | ব্যঞ্জনবর্ণের সাথে যুক্ত হলে পূর্বনির্ধারিত সহজাত স্বর "অ" উচ্চারিত হয় না |
ঽ | অবগ্রহ | স্বরবর্ণের শব্দ দীর্ঘ করার জন্য ব্যবহৃত উদাহরণ ১: শুনঽঽঽ (এইখানে "ন"-র পূর্বনির্ধারিত সহজাত স্বর "অ" দীর্ঘ করা হচ্ছে) উদাহরণ ২: কিঽঽঽ? (এইখানে "ক" এর সাথে যুক্ত স্বর "ই" দীর্ঘ করা হচ্ছে) |
্য | যফলা | "এ্যা" বা "অ্যা" উচ্চারণ বিশিষ্ট শব্দের জন্য ব্যবহৃত "মুখ্য"-এর মতন বানানে ব্যবহৃত ফরাসি ও জার্মান বর্ণ "ü"-কে "উ্য" আর "ö"-কে "ও্য" বা "এ্য" -তে প্রতিলিপি করা জন্য ব্যবহৃত। |
্র | রফলা | যুক্তাক্ষরের র-কারান্ত রূপ |
র্ | রেফ | যুক্তাক্ষরের র-কারাদি রূপ |
্ব | বফলা | শুধু সংস্কৃত থেকে গৃহীত শব্দের বানান সংরক্ষণ করার জন্য ব্যবহৃত যেমন, "স্বাধীন", "বিদ্বান", "বিশ্ব" মাঝে-মধ্যে ইসলাম-সংক্রান্ত আরবি শব্দ প্রতিলিপি করা জন্য ব্যবহৃত। উল্লেখ্যঃসব ব-কারান্ত যুক্তাক্ষরের 'ব' বফলা নয়; যেমন অম্বর, লম্বা, তিব্বত, বাল্ব এসব যুক্তাক্ষরের 'ব' বফলা নয়। |
৺ | ঈশ্বার | স্বর্গীয় অথবা মৃত ব্যক্তির নামের আগে এই চিহ্ন ব্যবহৃত |
ঀ | আঞ্জী (সিদ্ধিরস্তু) | আহাবন |
সংখ্যা
বিরামচিহ্ন ও অন্যান্য ব্যবহৃত চিহ্ন
চিহ্ন | চিহ্নের নাম |
---|---|
। | দাঁড়ি বা পূর্ণচ্ছেদ |
, | কমা |
: | কোলন |
; | সেমিকোলন |
:- | কোলন ড্যাস |
- | ড্যাশ বা হাইফেন চিহ্ন |
? | প্রশ্নবোধক চিহ্ন |
! | বিস্ময়বোধক চিহ্ন |
' | ইলেক বা লোপ চিহ্ন |
' ' | একক উদ্ধৃতি চিহ্ন |
" | যুগল উদ্ধৃতি চিহ্ন |
৳ | টাকা |
... | ঊহ্য বা বর্জন চিহ্ন |
/ | বিকল্প বা স্ল্যাশ চিহ্ন |
\ | ব্যাকস্ল্যাশ চিহ্ন |
[ ] ( ) { } ⟨ ⟩ | বন্ধনী চিহ্ন সমূহ |
° | তাপাঙ্ক / ডিগ্রী |
% | শতাংশ চিহ্ন |
~ | টিল্ডা চিহ্ন |
= | সমান চিহ্ন |
ঝঞ্জায়
কোনো স্বরবর্ণ দ্বারা পৃথক না থাকলে সর্বাধিক চারটি ব্যঞ্জনবর্ণ পরস্পর যুক্ত হয়ে যুক্তাক্ষর তৈরী করতে পারে। সাধারণতঃ প্রথম ব্যঞ্জনবর্ণ যুক্তাক্ষরের ওপরের দিকে বা বাম দিকে দেখা যায়। যুক্তাক্ষরে অনেক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণকারী ব্যঞ্জনবর্ণ সংক্ষিপ্ত আকারে লেখা হয়, আবার অনেক ক্ষেত্রে মূল ব্যঞ্জনবর্ণের সঙ্গে তার কোনো সাদৃশ্য থাকে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাধারণ অবস্থায় ব্যঞ্জনবর্ণের যা উচ্চারণ, যুক্তাক্ষরে ব্যবহৃত হলে তার উচ্চারণের পরিবর্তন হয়ে যায়। যেমন "জ" এবং "ঞ" এর মিলনের ফলে তৈরী "জ্ঞ" যুক্তাক্ষরের উচ্চারণ "জ্ন" না হয়ে হয় "গ্গ"।
ন্দ্র (ন + দ + র)
নিলীন রূপ
- উচুনিচু: ক্ক, গ্ন, গ্ল, ন্ন, প্ন, প্প, ল্ল, ইত্যাদি...
- ব-কারান্ত (বফলা এর অন্তর্ভুক্ত): গ্ব, ণ্ব, দ্ব, ল্ব, শ্ব ইত্যাদি...
- পাশাপাশি: দ্দ, ন্দ, ব্দ, ব্জ, প্ট, শ্চ, শ্ছ, ইত্যাদি...
আনুমানিক রূপ
- পাশাপাশি: দ্গ, দ্ঘ, ড্ড
- ব-কারান্ত (বফলা এর অন্তর্ভুক্ত): ধ্ব, ব্ব, হ্ব
সঙ্কুচিত রূপ
- পাশাপাশি: ঙ্ক্ষ, ঙ্খ, ঙ্ঘ, ঙ্ম, চ্চ, চ্ছ, চ্ঞ, ড্ঢ, ব্ব
- "ত", উচুনিচু: ত্ন, ত্ম, ত্ব
- "ম", উচুনিচু এবং পাশাপাশি: ম্ন, ম্প, ম্ফ, ম্ব, ম্ভ, ম্ম, ম্ল
- "ষ", উচুনিচু এবং পাশাপাশি: ষ্ক, ষ্ট, ষ্ঠ, ষ্প, ষ্ফ, ষ্ম
- "স", উচুনিচু এবং পাশাপাশি: স্ক, স্খ, স্ট, স্ত, স্থ, স্ন, স্প, স্ফ, স্ব, স্ম, স্ল
সংক্ষিপ্ত রূপ
- "জ", উচুনিচু এবং পাশাপাশি: জ্জ, জ্ঞ, জ্ব
- "ঞ", উচুনিচু এবং পাশাপাশি: ঞ্চ, ঞ্ছ, ঞ্জ, ঞ্ঝ
- "ণ" ও "প", উচুনিচু এবং পাশাপাশি: ণ্ঠ, ণ্ড, প্ত, প্স, প্ট, ণ্ট, ণ্ঢ
- "ত" ও "ভ", আকৃতি পরিবর্তন: ত্ত, ত্থ, ত্র, ভ্র
- "থ", উচুনিচু এবং পাশাপাশি: ন্থ, স্থ, ম্থ
- "ম", উচুনিচুতে নিচে (নিজের উপরের আকার প্রায় হারিয়ে দেয়): ক্ম, গ্ম, ঙ্ম, ট্ম, ণ্ম, ত্ম, দ্ম, ন্ম, ম্ম, শ্ম, ষ্ম, স্ম
- "স", উচুনিচুতে নিচে (নিজের উপরের আকার হারিয়ে দেয়): ক্স
বৈকল্পিক রূপ
- "ঙ", আকৃতি পরিবর্তন: ঙ্ক, ঙ্গ, উদাহরণ: অঙ্ক, সঙ্গীত,সঙ্গ ইত্যাদি।
- "ধ", আকৃতি পরিবর্তন করে আর "ঝ"-র মতন রূপ নেয়: গ্ধ, দ্ধ, ন্ধ, ব্ধ,ল্ধ,
- রেফ: র্ক, র্খ, র্গ, র্ঘ, ইত্যাদি...
- রফলা: খ্র, গ্র, ঘ্র, ব্র, জ্র, ট্র, ঠ্র, ড্র, ম্র, স্র, ইত্যাদি...
- রফলা যুক্ত হলে আকৃতি পরিবর্তন হয়: ক্র, ত্র, ভ্র
- যফলা: ক্য, খ্য, গ্য, ঘ্য, দ্য, ন্য, শ্য, ষ্য, স্য, হ্য, ইত্যাদি...
ব্যতিক্রমসমূহ
- "ক", "ত"-র মতন রূপ নেয়: ক্র, ক্ত
- "চ", "ব"-র মতন রূপ নেয়: ঞ্চ
- "ট"+"ট" (নিজের নিচে একটি বক্ররেখা তৈরি করে): ট্ট
- "ষ"+"ণ" -তে "ণ" নিজেকে ২বার বক্র করে: ষ্ণ
- "হ"+"ন" -তে "ন" নিজেকে বক্রের মতন করে নেয়: হ্ন
- "হ"+"ম" (আকৃতি পরিবর্তন): হ্ম
ব্যতিক্রমী ব্যঞ্জনবর্ণ-স্বরবর্ণ সমন্বয়
- উ
- "গ" আর "শ" -র সঙ্গে "উ" যুক্ত হলে "ও"- র মতন নিচে বক্র তৈরি করে: গু, শু
- "ন" বা "স" এর সাথে "তু" যুক্ত হলে "ও"- র মতন নিচে বক্র তৈরি করে: ন্তু, স্তু
- ব্যঞ্জনের ডানে বক্র তৈরি করে: রু, গ্রু, ত্রু, থ্রু, দ্রু, ধ্রু, ব্রু, ভ্রু, শ্রু
- "হ"-র সঙ্গে উপরে বক্র তৈরি করে: হু
- ঊ
- যুক্ত হলে ডানে ঘাই তৈরি করে: রূ, গ্রূ, থ্রূ, দ্রূ, ধ্রূ, ভ্রূ, শ্রূ
- ঋ
- "হ" -র সঙ্গে যুক্ত হলে ডানে ঘাই তৈরি করে: হৃ
কিছু উদাহরণ: স+ত +র=স্ত্র, ম+প+র=ম্প্র, জ+জ+ব=জ্জ্ব, ক্ষ+ম=ক্ষ্ম
- চারবর্ণের যুক্তাক্ষর হতে পারে যেমন ন+ত+র+য= ন্ত্র্য, স্বাতন্ত্র্য শব্দে এটি দেখা যায়
লিপি বৈশিষ্ট্য
বাংলা অক্ষরগুলির উপর মাত্রা অর্থাৎ একটি আনুভূমিক রেখা দেয়া হয়। বাংলাতে মাত্রার প্রদর্শন পরিমাণ অনেক কম। খ, শ, ণ, প, ইত্যাদি বাংলা হরফে মাত্রার পরিমাণ খুব কম। বাংলাতে একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের কিছু স্বতন্ত্র জ্যামিতিক বৈশিষ্ট্য এই প্রাক-মুদ্রণ যুগেই নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এগুলির মধ্যে নিচেরগুলি উল্লেখযোগ্য- অনুভূমিক মাত্রা এবং বিভিন্ন হরফে এর পরিমাণ
- বেশির ভাগ বাংলা হরফে ব্যবহৃত উল্লম্ব রেখাকৃতি অংশটি।
- ক, ঝ, ধ, ব, র, ইত্যদি হরফে ব্যবহৃত ত্রিভুজাকৃতি রূপটি। একই ত্রিভুজটির খানিকটা বিকৃত রূপ খ, ঘ, থ, ফ, য, ষ, ইত্যাদিতে দেখতে পাওয়া যায়।
- লেখার দিকের সাথে অর্ধ-সমকোণে অঙ্কিত বিভিন্ন রেখাংশ বিভিন্ন হরফে দেখতে পাওয়া যায়। ই, ছ, হ, ইত্যাদির নিচের অংশে, এবং গ, প, শ, ইত্যাদিতে উল্লম্ব রেখার সাথে সংযুক্ত অবস্থায় এরকম রেখাংশ দেখতে পাওয়া যায়।
এসময়কার বাংলা হরফে আরও কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল, যেগুলি বর্তমান বাংলা হরফে অনুপস্থিত। যেমন -
- "র" হরফটিকে "ব"-এর পেটে দাগ কেটে দেখানো যেত। অর্থাৎ পেট-কাটা "ব" (ৰ) দিয়ে এটি নির্দেশ করা হত। বর্তমানে এটি অসমীয়া ভাষাতে প্রচলিত হলেও বাংলায় আর প্রচলিত নেই।
- বর্তমান বাংলা বেশ কিছু হরফের নিচে ফুটকি বা বিন্দু দেয়া হয়। এই ফুটকিগুলি এই যুগে প্রচলিত ছিল না। "র"-কে পেটকাটা ব দিয়ে নির্দেশ করা হয়। "য়"-এর নিচে কোন বিন্দু ছিল না; এটি শব্দে অবস্থানভেদে ভিন্ন ভাবে উচ্চারিত হত। আবার "ড়" এবং "ঢ়"-এরও কোন অস্তিত্ব ছিল না। "ড" এবং "ঢ" শব্দের মাঝে বসলে "ড়" এবং "ঢ়"-এর মতো উচ্চারিত হত।
- ত+উ ব্যঞ্জন-স্বর সমবায়টি "ত্ত" দিয়ে প্রকাশ করা হত। আজও কোন কোন আধুনিক বাংলা যুক্তাক্ষরে, যেমন স+ত+উ = "স্তু" (যেমন- বস্তু) এবং ন+ত+উ = "ন্তু" (যেমন- কিন্তু) --- এই দুইটি যুক্তাক্ষরের ত+উ অংশে এর ফসিল দেখতে পাওয়া যায়।
বাংলা মুদ্রিত হরফের জ্যামিতিক গড়ন
প্রতিটি মুদ্রিত বাংলা হরফ একটি অদৃশ্য চতুর্ভুজের মধ্যে বসানো থাকে। হরফের এই অদৃশ্য নকশাতে অনুভূমিক বরাবর প্রসারিত বেশ কিছু রেখা বাংলা হরফের জ্যামিতিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করেছে।
মাত্রা বরাবর যে রেখাটি চলে গেছে, যা থেকে বেশিরভাগ হরফ ঝুলে থাকে বলে মনে হয়, তাকে মাত্রারেখা বলে। বেশির ভাগ হরফের নিচ যেখানে ঠেকে যায়, সেই বরাবর কল্পিত অনুভূমিক রেখাটিকে ভূমিরেখা বলে। রোমান হরফগুলির মূল অংশ সর্বদা একটি অদৃশ্য ভূমিরেখার উপর দাঁড়িয়ে থাকে। অন্যদিকে বাংলা হরফগুলি মাত্রা নামের একটি দৃশ্যমান রেখা থেকে নিচে ঝুলে থাকে। ফিওনা রস তাই বাংলা হরফের ভূমিরেখাকে "ধারণাগত ভূমিরেখা" আখ্যা দিয়েছেন। মাত্রারেখা থেকে ভূমিরেখার ব্যবধানকে "হরফের মূল উচ্চতা" বলে।
মাত্রারেখার কিছু উপরে আরেকটি অনুভূমিক রেখা কল্পনা করা যায়, যাতে ই-কার, ঈ-কার, ঐ-কার, রেফ ইত্যাদির মাথা গিয়ে ছুঁয়েছে; এটিকে শিরোরেখা বলে। একইভাবে ভূমিরেখার খানিকটা নিচে আরেকটি অনুভূমিক রেখা কল্পনা করা যায়, যেখানে উ-কার, ঊ-কার, ঋ-কার, ইত্যাদির নিচের প্রান্ত গিয়ে ঠেকেছে; একে পাদরেখা বলে। পাদরেখা থেকে শিরোরেখার ব্যবধানকে "হরফের উচ্চতা" হিসেবে ধরা যায়। মাত্রারেখার খানিকটা নিচে আরেকটি রেখা কল্পনা করা যায়, যেখানে বহু হরফের অংশবিশেষ দিক পরিবর্তন করে; একে মধ্যরেখা বলে।
প্রতিটি হরফ যে অদৃশ্য চতুর্ভুজাকৃতি স্থানে বসে, তার দুইপাশে খানিকটা খালি জায়গা থাকে, একে পার্শ্বস্থান বলে। দুপাশের পার্শ্বস্থান বাদ দিলে হরফের মূল প্রস্থ পাওয়া যায়। আর পাশাপাশি দুইটি হরফের প্রতিটির পার্শ্বস্থান যোগ করলে পাওয়া যায় ঐ দুই হরফের মধ্যে ফাঁক।