ভাষায় জন্য উচ্চারিত ধ্বনি গুলির একটি প্রকরণ হলো স্বরধ্বনি। যে সকল ধ্বনি উচ্চারণের সময় মুখবিবরে সরাসরি কোন বাধা পায় না, কিন্তু জিহ্বা ও ঠোঁটের অবস্থানের কারণে এগুলোতে ধ্বনিগত কিছু পরিবর্তন আসে, সে সকল ধ্বনিই হলো স্বরধ্বনি। যে সকল চিহ্ন দিয়ে এই ধ্বনিসমূহ প্রকাশ করা হয়, সেগুলোর প্রত্যেকটি স্বরচিহ্ন বা স্বরবর্ণ। বাংলা বর্ণমালায় স্বরবর্ণের সংখ্যা ১১টি। এগুলো হলো― অ, আ, ই, ঈ, উ, ঊ, ঋ, এ, ঐ, ও, ঔ।
মৌলিকতার বিচারে স্বরধ্বনির সংখ্যা মাত্র ৭টি। এই ধ্বনিগুলো হলো―অ, আ, ই, উ, এ, ও এবং এ্যা । এগুলোকে বলা হয় প্রাথমিক মৌলিক স্বরধ্বনি (Primery Cardinal Vowels)। অনেকে বাংলায় ৮টি মৌলিক স্বরধ্বনির কথা উল্লেখ করে থাকেন। কিন্তু সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করলে, ৮টি ধ্বনি পাওয়া যায় না।
মুহম্মদ আব্দুল হাই তাঁর ‘ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব’ গ্রন্থে অতিরিক্ত স্বরধ্বনি হিসাবে ‘অভিশ্রুত ও’ নামক একটি ধ্বনির উল্লেখ করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি ‘স্বাভাবিক ও’ ও ‘অভিশ্রুত ও’-এর মধ্যে মধ্যে তুলনা করতে গিয়ে- ওষ্ঠের কম গোল বেশি গোলকে যেভাবে প্রাধান্য দিয়েছেন, বাস্তবে তা সকল ক্ষেত্রে ঘটে না। তিনি স্বরবর্ণের মৌলিক অবস্থানের ছকে এই দুই ও-কে খুব কাছাকাছি দেখিয়েছেন। এক্ষেত্রে ‘অভিশ্রুত ও’-কে বলেছেন সিকি-সংবৃত। মূলত এই দুটো ও-এর উচ্চারণগত যে প্রভেদ একেবারেই নেই তা বলা যায় না, কিন্তু তাকে মৌলিক স্বরধ্বনি হিসাবে বিবেচনা না করে- ও ধ্বনির একটি প্রকরণ হিসাবেই বিবেচনা করাই বাঞ্ছনীয়। যে কারণে ই, ঈ এবং উ, ঊ মৌলিকতার বিচারে চারটি ধ্বনি বিবেচনা না করে, দুটো ধ্বনি হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
সুকুমার সেন তাঁর ‘ভাষার ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে দুটি 'আ' ধ্বনিকে মৌলিক ধ্বনি তালিকায় গ্রহণ করেছেন। এই দুটো ধ্বনির একটিকে তিনি আ (আ হ্রস্ব) ও আ (আ দীর্ঘ) নামে চিহ্নিত করেছেন। একথা সত্য যে, বাংলাতে কোনো কোনো ক্ষেত্র দীর্ঘ-আ অপরিহার্য হিসাবে বিবেচিত হয়। বিশেষ করে ব্রজবুলিতে দীর্ঘ আ-এর উচ্চারণ যথাযথভাবে না করলে, শব্দের স্বমহিমা নষ্ট হয়।
দীর্ঘ-হ্রস্বের এই পার্থক্য থাকলেও, একে মৌলিক ধ্বনি হিসাবে বিবেচনা না করে- আ ধ্বনির প্রকরণ হিসাবেই বিবেচনা করা উচিৎ। এছাড়া আ ধ্বনিটি যেখানে ভাবকে বিস্তৃত করে, সেখানে দীর্ঘ করলেই ভালো শোনায়। যেমন আসমুদ্রহিমাচল। এই শব্দের আ দীর্ঘ না করলে দোষ নেই, কিন্তু দীর্ঘ করলে অর্থের বিচারে শব্দটি স্বমহিমা পায়। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ধ্বনির ‘ভাষা প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ’ গ্রন্থে হ্রস্ব-দীর্ঘ উচ্চারণ অনুসারে বাংলা শব্দের অর্থের পরিবর্তন ঘটে না বলে দাবী করেছেন। কিন্তু হ্রস্ব-দীর্ঘ পরিবর্তনে ভাবগত মর্যাদার হ্রাস-বৃদ্ধি যে ঘটে থাকে, তার বিচার করেন নি।
উল্লিখিত বৈয়াকরণরা ছাড়াও অনেকেই মৌলিক ধ্বনি নিরুপণে শব্দের অর্থ নিয়ে বড্ড বেশি মাথা ঘামিয়েছেন। ধ্বনির হ্রস্ব-দীর্ঘ উচ্চারণে অর্থের পার্থক্য হলেই তা মৌলিক ধ্বনির ভিতর আনতে হবে তার কোন অর্থ হয় না। বড় জোর হ্রস্ব-দীর্ঘের বিচারে তাকে একটি মৌলিক ধ্বনির প্রকরণ হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। তাছাড়া বাংলাতে সকল ক্ষেত্রে এই হ্রস্ব-দীর্ঘ উচ্চারণ দিয়ে অর্থ পার্থক্য নিরুপণ করাও যায় না। কারণ―
১. যে সকল শব্দের দুটো অর্থ রয়েছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে অর্থের তারতম্যটা কখনো কখনো কানে ও মনে ধরা পড়ে বটে, কিন্তু যে সকল শব্দের অর্থ দুইয়ের বেশি আছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে কি হবে? যেমন একটি শব্দ ‘কর’। এর অর্থগুলোকে যদি পরপর লিখি, তাহলে তার রূপটি দাঁড়াবে নিচের তালিকার মতো-
কর : ক। হাত। খ। আলো, কিরণ, জ্যোতি। গ। রাজস্ব, খাজনা, শুল্ক ঘ। বাঙালি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বংশগত পদবী (সুশীল কর)। ঙ। উৎপন্ন অর্থে প্রত্যয় (সুখকর, হিতকর)। চ। করা অর্থে ক্রিয়াপদ (তুচ্ছার্থে)। তুই এ কাজটি শীঘ্র কর।
২. ব্যক্তিবিশেষের উচ্চারণগত পার্থক্যে একই ধ্বনির উচ্চারণে হ্রস্ব-দীর্ঘ রূপে পার্থক্য ঘটে থাকে। আবার বাক্যের ভাব অনুসারেও উচ্চারণে হ্রস্ব-দীর্ঘ রূপ পাল্টে যেতে পারে। যেমন― কোনো কিছু অনুমোদন করা অর্থে আমরা ‘বেশ’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকি। যখন তাড়াহুড়োর ভিতর অনুমোদন করি তখন ‘বেশ’ ছোট করে বলি। কিন্তু যখন প্রশান্ত মনে মাথা কাত করে আয়েসে অনুমোদন করি, তখন তা প্রলম্বিত হয়।
স্বরধ্বনির উচ্চারণগত বৈশিষ্ট্য
স্বরধ্বনির উচ্চারণগত বৈশিষ্ট্যকে বিশ্লেষণ করার জন্য, প্রাথমিকভাবে তিনটি বিষয় বিচার করা হয়। এই দিক তিনটি হলো―
১. জিহ্বার অবস্থান : স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময় জিহ্বাকে সামনে, পিছনে, উপরে নিচে সঞ্চালনের প্রয়োজন হয়। তাই এই ক্ষেত্রে জিহ্বার অবস্থানকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়।
২. জিহ্বার উত্থানগত পরিমাপ : জিহ্বা স্বাভাবিক অবস্থায় নিম্নচোয়ালের মধ্যভাগে শায়িত অবস্থায় থাকে। ধ্বনি উচ্চারণের সময় জিহ্বার বিভিন্ন অংশ উত্তোলিত করা হয়। জিহ্বার এই অংশ বিশেষের ব্যবহারের ধরনের উপর স্বরধ্বনির উচ্চারণগত বৈশিষ্ট্যের অনেকখানি নির্ধারিত হয়।
৩. ঠোঁটের আকৃতি : স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময় আমরা ঠোঁটকে কখনো গোল করা হয় বা কখনো প্রসারিত করা হয়। স্বরধ্বনি ভেদে ঠোঁটের এই আকারগত পরিবর্তনকেও বিবেচনায় আনা হয়।
প্রতিটি ভাষাতেই স্বরধ্বনি ব্যবহৃত হয় দুটি প্রক্রিয়ায়। এর একটি হলো― স্বাধীন বা মুক্তি স্বরবর্ণ। যেমন : অতি শব্দের অ। এর দ্বিতীয় প্রক্রিয়াটি হলো- ব্যঞ্জনবর্ণের সাথে যুক্ত অবস্থা। একে যুক্ত বা পরাধীন স্বরধ্বনি বলা যেতে পারে। অনেক সময় পাশাপাশি একাধিক স্বরধ্বনি থাকায় যৌগিক স্বরধ্বনির সৃষ্টি করে। বাংলাতে এই জাতীয় যৌগিক ধ্বনি অনেক থাকলেও, মাত্র দুটি চিহ্ন বা বর্ণ পৃথকভাবে দেওয়া হয়েছে। বর্ণ দুটি হলো ঐ এবং ঔ।
স্বরধ্বনি উচ্চারণে জিহ্বার অবস্থানগত পরিমাপ
স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময় জিহ্বা কতটুকু সামনে বা পিছনে এলো, কিম্বা কতটুকু উপরে বা নিচে নেমে এলো তা বাইরে থেকে দেখা যায় না। মুখের ভিতরে জিহ্বার অবস্থান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ভাষা বিজ্ঞানীরা একটি কৃত্রিম মানদণ্ড কল্পনা করে নিয়েছেন। এই মাপকাঠিটি trapezoid আকৃতির। এতে আনুভূমিক এবং সমান্তরাল চারটি রেখা রয়েছে। এর উপরে রেখাটি হলো তালুর প্রতীক এবং নিচের রেখাটি নিম্ন চোয়ালের ভিতর শায়িত জিহ্বার অবস্থানের প্রতীক। এর মাঝের দুটি রেখা জিহ্বার উত্থানের দাগাঙ্ক হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
আনুভূমিক রেখাগুলোকে প্রয়োজনানুসারে উলম্বভাবে বিভাজিত করা হয়। এই দাগাঙ্কের নিরিখে জিহ্বার অগ্র-পশ্চাৎ মান বিবেচনা করা হয়ে থাকে। বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত স্বরধ্বনিগুলোর উচ্চারণের মৌলিকত্বের বিচারে জিহ্বার অবস্থানকে ৭টি অবস্থানে নির্দেশিত করা হয়। এই ৭টি অবস্থানের নিরিখে বর্ণগুলোর অবস্থান নির্ণয় করা হয়। পাশের এই চিত্রের সামনের দিকের চারটি ও পিছনের চারটি বিন্দু দিয়ে ৮টি ধ্বনির অবস্থান দেখানো হয়েছে। এই বিন্দুগুলির ভিতর ১,২,৩,৪ সংখ্যা বিন্দুতে অবস্থিত বর্ণগুলির ক্ষেত্রে জিহ্বা সামনের দিকে চাপ সৃষ্টি করে। একইভাবে পিছনের ৫, ৬, ৭, ৮ বিন্দুগুলো জিহ্বার পিছনের দিকে চাপ সৃষ্টি করে থাকে। এই চাপ সৃষ্টির ক্ষেত্রে জিহ্বা উপরে বা নিচে, সামনে বা পিছনে অবস্থান নেয়। উল্লেখ্য নিচের ৪, ৫ বিন্দু দুটি আ ধ্বনির জন্য সাধারণ রেখা হিসাবে কাজ করে থাকে।
এক্ষেত্রে স্বরবর্ণ উচ্চারণের জন্য জিহ্বার অবস্থানটা মূলত যে দুটি দিক থেকে বিবেচনা করা হচ্ছে, তা হলো―
জিহ্বার অগ্র-পশ্চাত্গত অবস্থান
অপরটি জিহ্বার উত্থানগত অবস্থান।
জিহ্বার অগ্র-পশ্চাৎগত পরিমাপ
মৌলিক স্বরধ্বনিগুলো উচ্চারণের সময় উচ্চারণভেদে জিহ্বা তালুর দিকে উত্তোলিত করা হয়। জিহ্বার এই গতি প্রকৃতি অনুসারে মৌলিক স্বরবর্ণগুলোকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। ভাগগুলো হলো―
১. সম্মুখ : এক্ষেত্রে জিহ্বার সামনের দিকটা তালুর দিকে উত্থিত হবে। এই জাতীয় মৌলিক স্বরবর্ণগুলো হলো- ই, এ এবং এ্যা ।
২. পশ্চাৎ : এক্ষেত্রে জিহ্বার পিছনের দিকটা তালুর দিকে উত্থিত হবে। এই জাতীয় মৌলিক স্বরবর্ণগুলো হলো- উ, ও এবং অ।
৩. সমতল : এক্ষেত্রে জিহ্বার পুরো অংশটুকু নিম্নচোয়ালের মধ্যবর্তী স্থানে শায়িত থাকবে। বাংলা মৌলিক স্বরধ্বনিগুলোর ভিতরে একমাত্র আ ধ্বনিটি সমতলধর্মী।
পাশের চিত্রে জিহ্বার গতিপ্রকৃতি অনুসারে মৌলিক স্বরবর্ণগুলোর অবস্থান দেখানো হয়েছে। লক্ষ্য করুন, এখানে ই এবং উ ধ্বনি দুটি ছকের একটু ভেতরে দেখানো হয়েছে। কারণ, ইংরেজি I ধ্বনির উচ্চারণ এবং বাংলা ই ধ্বনির উচ্চারণে জিহ্বা সামনের দিকে একই অবস্থানে যায় না। একই কারণ ঘটে ইংরেজি U ও বাংলা উ ধ্বনির ক্ষেত্রেও। সে কারণেই, ইংরেজি I ধ্বনি এবং বাংলা ই ধ্বনিটির উচ্চারণ এক নয়। একই কথা U ও উ এর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
জিহ্বার উত্থানগত পরিমাপে স্বরবর্ণের পরিচয়
জিহ্বা তালুর দিকে উঠালে, তালু ও জিহ্বার মধ্যবর্তীস্থানের পথ সঙ্কীর্ণ হয়ে উঠে। এই সঙ্কীর্ণ স্থানের পরিমাণের উপর ভিত্তি করে- মৌলিক স্বরবর্ণগুলোকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগ চারটি হলো- সংবৃত, বিবৃত, অর্ধ-সংবৃত ও অর্ধ-বিবৃত।
ক। সংবৃত (Close) : জিহ্বা তালুর কাছাকাছি এনে বায়ু চলাচলের জন্য একটি সঙ্কীর্ণ পথ তৈরি করা হয়। এই অবস্থায় উচ্চারিত ধ্বনিগুলোকে সংবৃত বলা হয়। তালু সংলগ্ন ধ্বনি হিসাবে এদেরকে তালব্য বর্ণ বলা হয়। এক্ষেত্রে ঠোঁট প্রসারিত থাকে। পাশের চিত্রে সংবৃত উচ্চারণে জিহ্বার অবস্থান দেখানো হলো। লক্ষ্য করুন, এখানে ই ধ্বনিটির জন্য জিহ্বার সম্মুখভাগ প্রায় তালু সংলগ্ন হয়েছে এবং উ ধ্বনিটির জন্য জিহ্বার পশ্চাত্ভাগ প্রায় পশ্চাৎ তালুর সংলগ্ন হয়েছে।
খ। বিবৃত (Open) : এই জাতীয় ধ্বনি উচ্চারণে জিহ্বা ও তালুর ভিতর সব চেয়ে বেশি ফাঁকা জায়গার সৃষ্টি হয়। মুখ প্রসারিত করে এই ফাঁকা জায়গার পরিমাণকে আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয়। বাংলাতে এই জাতীয় স্বরবর্ণটি হলো আ। এক্ষেত্রে জিহ্বা স্বাভাবিকভাবে নিম্ন চোয়াল বরাবর শায়িত থাকবে। দীর্ঘ বা হ্রস্ব আ হিসাবে এর কোন পরিবর্তন ঘটবে না। আরবি ভাষার গলকক্ষ থেকে উচ্চারিত আ ধ্বনিটির ক্ষেত্রেও একই রীতি অনুসৃত হবে। কখনো কখনো জিহ্বার পশ্চাৎ অংশ ভিতরের দিকে সংকুচিত করে আ ধ্বনিটি উচ্চারণ করা হয়। এই ধ্বনিটিও বাংলাতে নেই। পাশের চিত্রে বিবৃত অবস্থায় আ ধ্বনির উচ্চারণে জিহ্বার অবস্থান দেখানো হল।
সংবৃত ও বিবৃত মধ্যরেখা
স্বরধ্বনি উচ্চারণে জিহ্বার উত্থানগত পরিমাপে আমরা দুটো চরম রেখা পেয়েছি। এর উপরের রেখাটি সংবৃত ও নিম্ন রেখাটি হলো বিবৃত। এবার এই দুটি চরম রেখার মধ্যভাগ দিয়ে যদি একটি আনুভূমিক রেখা টানি, তাহলে সংবৃত ও বিবৃত নামে দুটি অঞ্চল পাওয়া যাবে। পরের পৃষ্ঠায় মুদ্রিত চিত্রে সংবৃত ও বিবৃত অঞ্চল বিভাজনকারী এই মধ্যরেখাকে দেখানো হয়েছে। মধ্যরেখা দ্বারা বিভাজিত এই দুটি অঞ্চল অনুসারে মৌলিক স্বরবর্ণের অন্যান্য বর্ণগুলোকে (সংবৃত ও বিবৃত ছাড়া) দুটি পৃথক শ্রেণীতে বিভাজিত করতে পারি। এক্ষেত্রে এই শ্রেণী দুটো হবে, অর্ধ-সংবৃত ধ্বনি ও অর্ধ-বিবৃত ধ্বনি।
ক। অর্ধ-সংবৃত (half Close) : এই শ্রেণীর স্বরধ্বনি উচ্চারণের ক্ষেত্রে জিহ্বা মধ্যরেখাকে অতিক্রম করে সংবৃত অংশের কিছুটা অধিকার করবে। বাংলাতে এই শ্রেণীর দুটি ধ্বনি পাওয়া যায়। এই ধ্বনি দুটো হলো― এ এবং ও।
খ। অর্ধ-বিবৃত (half Open) : এই শ্রেণীর স্বরধ্বনি উচ্চারণের ক্ষেত্রে জিহ্বা মধ্যরেখাকে অতিক্রম না করে বিবৃত অংশের কিছুটা অধিকার করবে। বাংলাতে এই শ্রেণীর দুটি ধ্বনি পাওয়া যায়। এই ধ্বনি দুটো হলো- এ্যা এবং অ।
স্বরধ্বনি উচ্চারণে ঠোঁটের আকার
ধ্বনিগুলো উচ্চারণ করার সময় ঠোঁটের আকৃতি কেমনতর হয়, সেটাও দেখার বিষয়। সাধারণত স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময় আমরা আবদ্ধ ঠোঁট ঈষৎ উন্মুক্ত করি বা পুরো প্রসারিত করি। অনেক সময় ঠোঁট দুটো গোলাকার হয়। স্বরধ্বনির উচ্চারণের ক্ষেত্রে ঠোঁটের আকৃতি কিরূপ হবে, তা ধ্বনিবিজ্ঞানীরা বিশেষভাবে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন।
স্বাভাবিকভাবে বাইরে থেকে ঠোঁটের অবস্থা দেখে এর প্রকৃত আকার নির্ধারণ করতে গেলে, আমরা বিভ্রান্ত হবো। কারণ বাইরের দিক থেকে ঠোঁটকে যতটা প্রসারিত মনে হয়, প্রকৃত পক্ষে ঠোঁটের ভিতরের দিকটা ততটা নাও প্রসারিত নাও হতে পারে। বিষয়টি আমরা নিজেরাই পরীক্ষা করে দেখতে পারি। ধরা যাক আপনি ই ধ্বনিটি উচ্চারণ করবেন। প্রথমে এই ধ্বনিটি উচ্চারণ করে ঠোঁটকে স্থির রাখুন। এবার বাইরের দিক থেকে আঙুল স্পর্শ করে ঠোঁটের প্রসারণ লক্ষ করুন এবং একই সাথে ভিতর থেকে জিহ্বার অগ্রভাগ দিয়ে উভয় ঠোঁটের মধ্যবর্তী ফাঁকাস্থান নির্ণয়ে চেষ্টা করুন। এই অবস্থায় আপনি যদি আয়নার ভিতর দিয়ে আপনার ঠোঁটের আকার লক্ষ্য করেন, তা হলে সব মিলিয়ে আপনি বিভ্রান্তিতে পড়ে যেতে পারেন। ঠোঁটের বাইরের দিক থেকে দেখতে গেলে যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়, তার প্রধান দুটি কারণ-
১. ঠোঁটের ভিতরের অংশ বাইরে থেকে ভালো ভাবে দেখা যায় না।
২. ব্যক্তি বিশেষে ঠোঁট মোটা বা পাতলা হতে পারে। সাধারণত মোটা বা মাংসল ঠোঁটের ভিতরের অংশ বেশি ফাঁকা জায়গা সৃষ্টি করতে পারে না। তাই ই ধ্বনির ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট উচ্চারণ করার জন্য মোটা ঠোঁটের অধিকারীরা ঠোঁট দুটো অপেক্ষাকৃত বেশি প্রসারিত করেন।
যা হোক স্বরধ্বনি উচ্চারণে ঠোঁট গোল করা হবে, না স্বাভাবিকভাবে প্রসারিত হবে- তা নির্ভর করবে, কোন স্বরধ্বনিটি উচ্চারিত হবে তার উপর। এই অবস্থার বিচারে স্বরধ্বনি উচ্চারণে ঠোঁটের আকার পরিবর্তনকে- প্রাথমিকভাবে দুটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এই ভাগ দুটি হলো
ক. স্বাভাবিক প্রসারিত বা অগোলকৃত (Spread/Unrounded) : ঠোঁট দুটিকে একটু উন্মুক্ত করে এই জাতীয় ধ্বনি উচ্চারণ করা হয়। এক্ষেত্রে স্বভাবিকভাবে ঠোঁট যেভাবে থাকে তার চেয়ে বেশি করে দুই দিকে প্রসারিত করা হয় না। প্রসারণ যা ঘটে তা হলো ঠোঁটের উপর-নিচ বরাবর। বাংলা ভাষায় এই জাতীয় ধ্বনিগুলোর ভিতর রয়েছে ই, এ, এ্যা, আ।
দেখা যায় প্রসারণের বিচারে দেখা যায়- ই উচ্চারণের সময় ঠোঁট দুটোর প্রসারণ অপেক্ষাকৃত কম। এ ধ্বনিটি উচ্চারণর সময় ই অপেক্ষা একটু বেশি ঠোঁট ফাঁক করতে হয়। আবার এ্যা ধ্বনিটির ক্ষেত্রে এই প্রসারণের পরিমাণ এ অপেক্ষা বেশি। সর্বশেষ আ ধ্বনিটর ক্ষেত্রে প্রসারণের পরিমাণ হয়ে থাকে সর্বাধিক। এই বিচারে এই ৪টি ধ্বনি উচ্চারণের ক্রমমান হলো-
ই <এ <এ্যা <আ
পাশের চিত্রে ই এবং আ ধ্বনি উচ্চারণে ঠোঁটের যে আকার সৃষ্ট হয়, তার নমুনা দেখানো হলো।
খ. বর্তুলাকার (Rounded) : এক্ষেত্রে ঠোঁট দুটিকে একটু উন্মুক্ত করে এই জাতীয় ধ্বনি উচ্চারণ করা হয়। বাংলাতে এই জাতীয় ধ্বনিগুলো হলো-অ, ও এবং উ।
বর্তুলাকার স্বরধ্বনিগুলোর ভিতর অ-ধ্বনিটির ক্ষেত্রে দেখা যায়, ঠোঁট দুটো বড় ধরনের গোলাকার অবস্থায় পৌঁছায়। মাঝারি ধরনের গোলাকার অবস্থার সৃষ্টি হয়- ও-এর ক্ষেত্রে। কিন্তু উ উচ্চারণের সময়, ঠোঁট দুটো গোলাকার হয়ে সর্বোচ্চ সঙ্কোচন মাত্রায় পৌঁছায়। এই বিচারে এই ৩টি ধ্বনি উচ্চারণের ক্রমমান হলো- অ >ও>উ।
পাশের চিত্রে উ এবং অ ধ্বনি উচ্চারণে ঠোঁটের যে আকার সৃষ্ট হয়, তার নমুনা দেখানো হলো।
স্বরবর্ণের নাসিক্য ও সানুনাসিক গুণ
স্বরবর্ণের সাথে নাসিক্য ধ্বনি যুক্ত করার সময়, আমরা আল্জিহ্বা ও কোমল তালু জিহ্বামূলে পুরোপুরি নামিয়ে আনি না। সেই কারণে, স্বরবর্ণ নাসিক্য না হয়ে সানুনাসিক স্বরধ্বনি (Nasalized vowel) হয়। এই নিয়মে স্বরধ্বনিগুলোকে লিখা যেতে পারে অঁ, আঁ ইত্যাদি রূপে। কিন্তু ম, ণ ও ন এর সাথে যুক্ত স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময় উচ্চারিত অ ধ্বনিটি নাসিক্য স্বরবর্ণে পরিণত হয়। আবার এর সাথে অন্য কোন স্বরবর্ণ যুক্ত হলে, উক্ত স্বরবর্ণটি সানুনাসিক হয়ে যায়। যেমন- মা। এখান ম ধ্বনিটি নাসিক্য। কিন্তু যখন মা ধ্বনিটি উচ্চারিত হয়, তখন এর সাথের আঁ ধ্বনিটি (ম + আঁ) সানুনাসিক হয়ে যায়। এই কারণে একে বলা হয় সানুনাসিক ব্যঞ্জনধ্বনি।
বাংলা ভাষায় স্বীকৃত মৌলিক ধ্বনিগুলোর প্রকৃতি
অ
ও {স্বরধ্বনি, মৌলিক, বিবৃত-মধ্য, পশ্চাৎ, অবর্তুলাকার}
{স্বরধ্বনি, মৌলিক, সংবৃত-মধ্য, পশ্চাৎ, বর্তুলাকার}
আ {স্বরধ্বনি, মৌলিক, বিবৃত, সমতল, অবর্তুলাকার}
ই (ঈ) {স্বরধ্বনি, মৌলিক, সংবৃত, সম্মুখ, অবর্তুলাকার}
উ (ঊ) {স্বরধ্বনি, মৌলিক, সংবৃত, পশ্চাৎ, বর্তুলাকার}
এ {স্বরধ্বনি, মৌলিক, সংবৃত-মধ্য, সম্মুখ, অবর্তুলাকার}
এ্যা {স্বরধ্বনি, মৌলিক, বিবৃত-মধ্য, সম্মুখ, অবর্তুলাকার}
একাধিক স্বরধ্বনি এক ধাক্কায় উচ্চারিত হওয়ার সূত্রে যৌগিক স্বরধ্বনি সৃষ্টি করে। বাংলাতে যৌগিক স্বরধ্বনির ব্যবহার প্রচুর।